ব্যবসায়ী ও চাষিরা বলছেন, বাগেরহাটে দেড় শ কোটি টাকা মূল্যের কাঁকড়া মারা গেছে। আর চীনে রপ্তানি করা কাঁকড়ার মূল্য বাবদ অনেক ব্যবসায়ীর কোটি টাকা পর্যন্ত আটকা পড়েছে। এ অবস্থায় কাঁকড়া রপ্তানির জন্য নতুন আন্তর্জাতিক বাজার খোঁজার দাবি করছেন তারা।
সদর উপজেলার মাঝিডাঙ্গা গ্রামে গিয়ে দেখা যায় ঘেরের পাড়ে স্তুপ করে রাখা হয়েছে মৃত কাঁকড়া। চাষিরা ঘের থেকে কাঁকড়া তুলে পাড়ে ফেলছেন। ঘেরের পানিতে পা ফেলতেই পাচ্ছেন মরা কাঁকড়া। আর বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে দুর্গন্ধ।
একইভাবে বাজারে কাঁকড়া ক্রয় কেন্দ্রগুলোতে দেখা গেছে, কাঁকড়ার ঝুড়ি প্রায় শূন্য। বাজারে কাঁকড়ার সরবারহ নেই বললেই চলে।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, লাভজনক হওয়ায় বাগেরহাটের চাষিরা কাঁকড়া চাষে ঝুঁকেন। এতে মৎস্য বিভাগও উৎসাহিত করায় একের পর এক ঘের ও চাষির সংখ্যা বাড়তে থাকে। এ জেলায় সাধারণত দুভাবে কাঁকড়া চাষ হয়। এর মধ্যে সুন্দরবন এবং পাশ্ববর্তী বিভিন্ন নদী-খাল থেকে কাঁকড়া সংগ্রহ করে ঘেরে মজুত রাখা হয়। এছাড়া বাচ্চা কাঁকড়া ঘেরে ছেড়ে বড় করা হয়। এখানকার কাঁকড়া দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বাজার দখল করে নিয়েছে। তবে বিগত কয়েক বছরে কাঁকড়ার বড় বাজার তৈরি হয় চীনে।
এ ব্যাপারে বাগেরহাটের কাঁকড়া ব্যবসায়ী সাধন কুমার সাহা জানান, দেশে উৎপাদিত শতকরা ৮৫ ভাগ কাঁকড়া চীনে রপ্তানি করা হয়। আর সামান্য পরিমাণ কাঁকড়া তাইওয়ান, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে যায়। বাগেরহাট থেকে প্রতি মাসে গড়ে ২০০ টন কাঁকড়া রপ্তানি হয়। ওই কাঁকড়া আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় ১৫-২০ কোটি টাকায় বিক্রি হয়।
তিনি বলেন, সর্বশেষ গত ২২ জানুয়ারি তার কাঁকড়া চীনে রপ্তানি হয়। এরপর থেকে বন্ধ রয়েছে। তার নিজের রপ্তানি করা কাঁকড়ার মূল্য বাবদ ৫০ লাখ টাকার ওপরে আটকা পড়ে আছে।
ব্যবসায়ী সাধনের দেয়া তথ্যমতে, রপ্তানি বন্ধ থাকার কারণে ঘেরের শতকরা ৭০ ভাগ কাঁকড়া মারা গেছে। আর যা আছে তাও কয়দিন থাকলে মারা যাবে। চলমান পরিস্থিতিতে জেলায় এ শিল্পের সাথে জড়িত ৫০ হাজার ব্যবসায়ী, জেলে এবং শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
মাঝিডাঙ্গা গ্রামের মো. শেখ সেলিম ও মো. বেল্লাল হোসেনসহ বেশ কয়েকজন চাষি জানান, ২৫ দিন আগে থেকে ঘেরে কাঁকড়া মরা শুরু হয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার কাঁকড়া মরছে। বাজারে এক মাস আগে যে এক কেজি কাঁকড়া ১২০০-১৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে তা এখন মাত্র ২০০-২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রামের চাষি পলাশ মাহমুদ জানান, আড়াই থেকে তিন মাসের মধ্যে কাঁকড়া পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয়। এর মধ্যে বিক্রি না হলে এমনিতেই মরে যায়। কারণ এ সময় মা কাঁকড়ার পেট ডিমে পরিপূর্ণ থাকে। আর পুরুষ কাঁকড়ার খোলস পরিবর্তনের সময় এসে যায়। ডিম ছাড়া এবং খোলস পরিবর্তনের জন্য কাঁকড়াদের সাগর ও নদ-নদীতে চলে যেতে হয়। কিন্তু বদ্ধ জায়গায় থাকলে তারা মারা পড়ে।
রপ্তানি বন্ধ থাকায় বর্তমানে ঘেরে যে কাঁকড়া রয়েছে তা কেউ কিনছে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
একই উপজেলার ধানসাগর এলাকার চাষি আলিম হাওলাদার জানান, গত বছর তার প্রায় আট লাখ টাকা লাভ হয়। কিন্তু এবার লাভ তো দূরের কথা আসলও থাকবে না।
জেলা মৎস্য অফিসের তথ্যমতে, বাগেরহাটে তিন হাজার ৭৪৮ জন কাঁকড়া চাষি রয়েছেন। আর এক হাজার ৪১০ হেক্টর জমিতে তিন হাজার ৭৭৮টি কাঁকড়ার ঘের রয়েছে। এগুলোতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুই হাজার ৬২৯ মেট্রিক টন কাঁকড়া উৎপাদন হয়।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. মো. খালেদ কনক বলেন, ঘেরে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত কাঁকড়া মজুত ও লবণাক্ততার কারণে কাঁকড়া মারা যাচ্ছে। এ জন্য বিভিন্ন উপজেলায় সচেতনতামূলক সভা করা হয়েছে। যে সব ঘেরে অতিরিক্ত কাঁকড়া মজুত আছে তা সরিয়ে অন্য জলাশয়ে রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। একই সাথে অন্যান্য দেশে কাঁকড়ার বাজার খোঁজার পরামর্শ দেন এ মৎস্য কর্মকর্তা।